পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১৬)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:০০:০০ সকাল
মিথিলা!
কলেজে আমার প্রথম দিনটা খুব অদ্ভুত ছিল। আগের দিন আমার এক নানাভাই মারা গিয়েছিলেন। মন খারাপ ছিল। আরো খারাপ লাগছিল মা নানাবাড়ি চলে গিয়েছিলেন বলে। চাঁপা আর বাদল ও মায়ের সাথে গিয়েছিল। বাবা আর আমি বাসায়। মা কাজকর্ম বিলুর মা'কে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এমন একটা দিনে মা নেই, ঘরটা খালি। কেমন শুন্য শুন্য লাগছিল সব। বাবা অফিসের জন্য বের হবার আগে আমার রুমে এলেন। কতদিন পর! আমি রেডি হয়ে জুতোর ফিতা বাঁধছিলাম। খেয়াল করিনি। ফিতা বেঁধে উঠে দাঁড়াবার আগে মুখ তুলেছি, দেখি বাবা!সেই মুহুর্তের সেই অনুভূতি পুরোপুরি প্রকাশ করা কি সম্ভব? আবিষ্কার করলাম, বিরোধ -বিবাদ বাইরের কিছু, বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা ভিতরের! কিছু দিয়ে সেটা ছিন্ন করা অসম্ভব! বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে কেমন ছোট ছোট লাগছিল। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, ' বড় হও।' অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। বাবার হাতের পাঁচশো টাকার নোটটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি করব?' বাবা বললেন, 'আজ তোমার কলেজে প্রথম দিন, পছন্দমত কিছু কিনে নিও '..
আমার রুম থেকে বের হয়ে বাবা নিজের রুমে ঢুকা পর্যন্ত তাকিয়ে রইলাম। বাবার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। কেমন নরম হয়ে গেছেন! মনের ভিতরে মোচড় দিল। বিলুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা খেয়েছেন কিনা। বিলু মাথা ঝুঁকালো,'হ্যা'।
বাবা বের হবার পর আমিও বের হলাম। গেট থেকে রাস্তায় নেমে বাতাসে হঠাৎ মনটা পালকের মত হালকা লাগল। মাথায় বাবার স্পর্শটা আবার অনুভব করলাম। শরীরটা শান্তিতে ছেয়ে গেল। গলি থেকে বের হবার আগে আড়চোখে লাভলিকে সেদিন যে জানালায় দেখেছিলাম সেদিকে দেখলাম। খোলা। পর্দা সরানো। কেউ নেই।
পরিচিত দু'চারজনের সাথে দেখা হল। আমার রেজাল্টে তাদের খুশি জানালেন। দোয়া করলেন। ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। সবার কথাবার্তায় সমীহটা বেশ স্পষ্ট। নিজেকে শক্ত সমর্থ, বড় লাগছিল। ঠিক এর উল্টোটা বোধ হল কলেজে ঢুকে সিনিয়র ভাইদের সামনে পড়ে। কলেজে আমরা ফার্স্ট ইয়ার সবচেয়ে ছোট !
প্রথম দিনটা গেল শুধু পরিচয় দিতে আর নিতে। করিডোর ধরে হেটে যেতে যেতে অদ্ভুত লাগছিল। 'এই কলেজ এখন আমার!'
এস এস সি'র গ্রুপ যা ছিল কলেজেও তাই রইল। সায়েন্সেই থেকে গেলাম। গ্রুপ না বদলালেও ক্লাসের ধরণ ধারণ সবই নতুন। নতুন ক্লাস। নতুন শিক্ষক। নতুন জীবন। নতুন বন্ধু। নিজেকে মনে হচ্ছে নতুন। চারপাশটা বদলে গেলে মানুষের ভিতরটাও কিছুটা বদলে যায় আসলে। খুব ভালো লাগছিল। অনেকগুলি দিন কঠিন রুটিনে কাটিয়ে হঠাৎ এমন মুক্তির পর তাল রাখতে একটু কষ্ট হয়ে যেত। মাঝে মাঝেই সামান্য দ্বিধা আর অস্বস্তি ও উঁকিঝুঁকি দিত। কি কারণে জানি না মাঝে মাঝে অন্যমনষ্ক হয়ে যেতে ভালো লাগত। নিজের গভীরে ডুবে নিজেকে দেখা। সপ্তাহখানেক গেল।
মা আর বাদল প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার সারাদিনের গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব থাকেন। ছোট ছোট ঘটনার বড় বড় অনুভুতি, আরো বড় বিবরণ। সপ্তাহ শেষে উচ্ছ্বাস খানিক কমল। ইতোমধ্যে বাসায় সবার সামনেই দাড়ি গোফ শেভ করতে শুরু করেছি। অনেকটা ঘোষনা দেয়ার মত, ' আমি বড় হয়ে গেছি! '
দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে একদিন কলেজের গেটে দেখি লাভলি! বুকের ভিতর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। আরো কয়েকজন বান্ধবি সহ সে বেশ হাসিমুখে গল্পে মশগুল। আমাকে দেখেনি। আমি জানতাম না ও এই কলেজে ভর্তি হয়েছে। লাভলি 'র সামনের মেয়েটা আমাকে দেখে কিছু বললো। ফিরে আমাকে দেখে ওর হাসি আরো উজ্জ্বল হল। ইশারায় ডাকল। আমার হঠাৎ খুব লজ্জা হল। বন্ধুদের মধ্যে দু'একজন সব দেখছিল, হাসছিল। আমি হেসে মুখ ফিরিয়ে ক্লাসে চলে গেলাম। আমার বুকের ভিতর ড্রাম বীট হচ্ছিল। নার্ভাস লাগছিল। সেই ক্লাসে স্যার কী পড়ালেন কিছুই শুনলাম না। মাথা নিচু করে বেঞ্চের নিচে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলোম। কান দিয়ে আগুন যাচ্ছিল। কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে পারলাম না। ক্লাস শেষে লাভলি নিজেই যেচে কথা বলল। সৈয়দা সায়কা সুলতানা লাভলি খুলনা মন্নুজান গার্লস হাইস্কুলে পড়ত। সেখান থেকে এস এস সি পাস করে বি এল কলেজে ভর্তি হয়েছে। সিক্স সেভেনে ওদের বাসায় খুব আসা যাওয়া ছিল। বাবরের ঘটনার পর ওই বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। ক্লাস এইটে উঠার পর প্রথম সামনাসামনি কথা হল লাভলি'র সাথে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। স্বপ্নের মত লাগছিল। ও সারাক্ষণ কথা বলছিল। কথাগুলি ঝর্ণার মত লাগছিল। ঘরে এসেও ওর কথাগুলি ঘুরেফিরে মনের মধ্যে আসা যাওয়া করতে লাগল। সারাক্ষণ গুনগুন গানে ওর মুখ, ওর ভংগি মনে ভাসে। পরীক্ষার রেজাল্টের পর ওর পাঠানো সেই কার্ডটার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকি। গোলাপি রং এর উপরে একটা সাদা আর একটা লাল গোলাপ। দুটো লাল গোলাপের আধফোটা কুঁড়ি। কার্ডের উপর হাত রেখে ওর স্পর্শ পাই। শরীর অবশ হয়ে আসে। রান্নাঘরে বা মায়ের রুমে প্রতি সন্ধ্যার গল্পের আসরে মনোযোগ কমতে থাকল। টিভির সামনে বসে নাটক দেখছি হয়ত, কেউ জিজ্ঞেস করলে আর ঠিকঠাক কিছু বলতে পারি না। কোন না কোন সূত্রে লাভলিকেই মনে পড়ে যায়। আমার জগৎ লাভলিময় হয়ে গেল। নাটকের নায়িকার সাথে ওর মিল পাই। প্রিয় কবির কবিতার লাইনগুলি মনে হয় ওকে নিয়ে লেখা। গানগুলি মনে হয় ওরই জন্য। বাবার অফিসের পিকনিকে শহরের কিনারায় একটা জায়গায় গেছি, পুকুর ঘাটে বসে মনে হলো লাভলি ওই ঘাট। তার সাথে মনে মনে কত কথা। আকাশে মেঘ দেখে মনে হয় ও। উড়ন্ত পাখিটাকে মনে হয় ও। আমি আবেগ লুকাতে পারি না। মনে হয় সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে গেল। বন্ধুদের মধ্যে দু'একজন আমার ব্যাপারটা কিছু অনুমান করল। তারা ঠাট্টা তামাশা করতে লাগল। লাভলি'র ক্লোজ বান্ধবী দু'জনের মধ্যে একজন মিনা, আমাদের ক্লাসমেট আরিফুলের চাচাতো বোন। কিছু বন্ধু তার সুত্রে নিশ্চিতভাবে জেনে গেল। এই জানাজানিটাও খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু যার জানা দরকার, সেই লাভলিকেই কিছু বলতে পারছিলাম না। সমস্ত উচ্ছ্বাস বুকে তোলপাড় করে, মুখে আসে না। একা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে গান গাই , " কেমন করে হায় বলবো তোমাকে - বন্ধু আমি তোমায় ভালোবাসি! " আমি বুঝতে পারি না, ও কি আমাকে বোঝে? ও কি আমাকে ভালোবাসে! ইচ্ছে করে খোলা মাঠে চিৎকার করি, ' তুমি কি আমার??? ' কলেজ থেকে ফেরার পর থেকে শুধু পরদিন ক্লাসের টাইমের জন্য অধীর অপেক্ষা।
ক্লাস হচ্ছিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ভালো লাগা লেনদেন হচ্ছিল। কলেজের গেটের সামনে, ক্যান্টিনের সামনে, ক্লাসে, করিডোরে দু'জন পাশাপাশি দাঁড়ালাম, হাটলাম, একে অন্যকে প্রাণভরে দেখলাম, অফুরন্ত কথা হল। ক্লাসের বাইরেও আড্ডা হত। এত বন্ধু, এত সব কিছুর ভীড়ে সে আমার বিশেষ একজন হয়ে রইল। ধীরে ধীরে আমরা একে অন্যের মনের খুব কাছে চলে এলাম। দিনগুলি উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছিল।
একদিন ক্লাস শুরুর আগে আরো কয়েকজন বন্ধুর সাথে লাভলিকে দেখলাম গল্প করতে। কেউ হাই বেঞ্চে, কেউ লো বেঞ্চে। ছেলেদের মধ্যে ও একজনমাত্র মেয়ে। ওর স্বভাবমত হাসছে, গল্প করছে। বাকিরা উৎসাহ নিয়ে শুনছে, জবাব দিচ্ছে। আমি জানালার ভিতর দিয়ে দেখলাম। দৃশ্যটা আমার অনুভুতিতে তীরের মত বিঁধল। আমি নেই, ও এত খুশি! ওকে ছাড়া আমি কি কোন আনন্দ কল্পনা করতে পারি? দু'একজন ক্লাসমেটকে মনে হল অতি উৎসাহী। এদের মধ্যে একজন ভালো দাবাড়ু। ব্রিলিয়ান্ট। নিজের অজান্তেই ওর আশে পাশের সবার সাথে নিজের তুলনা করে ফেললাম। অশান্তি বোধ হচ্ছিল। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ছিল যা আমার ছিল না। মনটা অস্থির হয়ে গেল। ক্লাসের দরজা দিয়ে ঢুকতেই সবাই হল্লা করে উঠল, "চলে এসেছে!" আমি হাসলাম কিন্তু ভিতরটা তেতো হয়ে রইল। সচরাচর যে সিটে বসতাম তা পার হয়ে সবার পিছনে গিয়ে বসলাম। বসে মনে হল ক্লাস করা সম্ভব না। উঠে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছন থেকে লাভলি একবার ডাকল। আমি ফিরে তাকিয়ে হেসে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ও আহত হল। ওর সেই দৃষ্টি মনে হয় এখনো দেখি। খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি জানতাম, দোষ আমার ভাবনারই। কিন্তু কেন যেন ফিরে যেতে পারলাম না।
তাল কেটে গেল। লাভলির এক অন্য রূপ দেখলাম। সে সম্পূর্ণ নিরব হয়ে গেল। সবার সামনে ওকে ওভাবে অবহেলা করে ফেলে আসাটা ওর মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছিল। আমার ও অপরাধবোধ হচ্ছিল। বিনামেঘে বাজ পড়ার মত সমস্ত সব আনন্দ পুড়ে গেল। লাভলি'র সাথে আর কথা হয় না। একেবারে অচেনার মত পাশ কাটিয়ে চলে যেত। আমিও ডাকতাম না। এই সময় খুব মাথাব্যথায় ভুগলাম। মনের ছাপ শরীরে পড়ল। অসুখে পড়লাম। প্রচন্ড জ্বরে ভুগলাম সপ্তাহ খানেক। ওষুধে জ্বর সারল। শরীর দুর্বল হয়ে গেল।
একদিন মা আমার টেবিল গুছাতে গিয়ে লাভলির দেয়া কার্ডটা দেখে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, 'কে?' বললাম, 'ক্লাসমেট'। আমি জানতাম, লাভলির পরিবারকে মা পছন্দ করেন না। মা কার্ডটা বইয়ের ভাজে রেখে চলে গেলেন। বিছানায় শুয়ে খোলা জানালায় আকাশ দেখে উদাস হলাম। পড়ার টেবিলের একপাশে রাখা ক্যাসেট প্লেয়ারে তখন গান বজছে, " দৃষ্টি প্রদীপ জ্বেলে খুঁজেছি তোমায় ! ...."
সেদিন সন্ধ্যায় ক্লাসমেট, বন্ধু বাবলু আর আরিফুল বাসায় এলো। যাওয়ার সময় বাবুলের অগোচরে আমার বালিশের নিচে এক টুকরো কাগজ রেখে গেল। খুলে দেখলাম, লাভলির লেখা, ' কেমন আছো?'
'কেমন আছি! 'মন হাহাকার করে উঠল, ' ভালো নেই! ভালো নেই! 'মুঠোর মধ্যে রাখা চিঠিটার উত্তাপে জমাট বাধা অভিমানের বরফ কিছুক্ষণের মধ্যেই গলে ঝর ঝর করে দুই চোখ থেকে ঝরতে শুরু করল। অনেক দিন পর অনেক কাঁদলাম। কেঁদে মনটা হালকা হল।
অসুখ থেকে উঠে কলেজে প্রথম দিনটাতে লাভলি ক্লাসে এলো না। কী কষ্টে যে কাটল দিনটা। পরদিন ক্লাসে ঢুকে দেখলাম ও বসে আছে। একা। চুপচাপ। কিছু লিখছিল। দরজায় শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখল আমি। ওর মুখটা উজ্জ্বল হল। কিন্তু সেই উচ্ছ্বলতা নেই। চোখ গুলি মনে হল গভীর কোন দীঘি। অভিমান?
ও খাতা কলম বন্ধ করে আমার দিকে ঘুরে বসল। একটু হাসল। জিজ্ঞেস করল,'ভালো আছো এখন? ' মাথা নেড়ে বোঝালাম, 'হ্যা'। ও ওর সিটে বসে রইল। আমার পা গুলি তীব্রভাবে টানতে লাগল ওর কাছে যাওয়ার জন্য। শরীরটা পাথরের মত ভারী লাগল। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। একটা ঘোরের মধ্যে সময় যাচ্ছিল। করিডোরে আওয়াজ পেতে ধ্যান ভাংলো। ও আমার চোখ থেকে চোখ নামালো। ও মেয়েদের রো'তে বামের সিটে। আমি ওর পাশের ছেলেদের রো'তে ডান কিনারার সিটে বসলাম। আচ্ছন্নের মত লাগছিল। দুই হাতে মাথা ধরে বসে রইলাম। কেমন একটা রাগ সারা শরীরে বইছিল। তার উৎস জানা নেই।
মনে হল কোথাও ওর সাথে একা দেখা হওয়া খুব দরকার। কিছু বলার আছে।
ক্লাসে মন দিতে পারলাম না। ক্লাস শেষে লাভলি ওর বান্ধবীদের সাথে চলে গেল। আরিফুল আমার সাথে আমাদের গলির মুখ পর্যন্ত এলো। কথা হল, মিনার বাসায় লাভলি'র সাথে দেখা হবে। কখন তা' পরদিন জানাবে আরিফুল। আমি কৃতজ্ঞতায় বন্ধুর হাত ধরে বন্ধুকে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বন্ধু বুঝল। হাসল। পিঠে চাপড় দিয়ে হেসে বিদায় নিল।
বাসায় ফিরলাম হালকা মনে। অনেক দিন পর স্বাভাবিকভাবে সবার সাথে মন খুলে মিশলাম। টিভি দেখলাম। সন্ধ্যার পর গলির মুখের রেস্টুরেন্ট থেকে পরোটা আর কলিজাভুনা আনতে যাচ্ছিল বাদল। আমিও গেলাম। রাস্তায় হাটতে হাটতে দেখলাম লাভলি'র রুমে জানালায় পর্দা নামানো। ভিতরে উজ্জ্বল আলো। পর্দার ফাঁক দিয়ে ওর রুমের ছাদের সাদা আলো দেখা যাচ্ছিল। বাদলের চোখ এড়িয়ে তৃষ্ণার্তের মত আমার চোখ ওকে খুঁজল। একবার যদি জানালায় দাঁড়াতো!
....
মিনা'র বাসায় আমার আর লাভলি'র দেখা হওয়ার ব্যবস্থা হল। সেদিন মিনা'র মা বাবা, ছোটভাই একটা দাওয়াতে যাবেন। মিনা একা থাকবে। ওর বাবা মা'কে বলেছে ওর কলেজের বন্ধুরা আসবে। উনারা দু:খ করলেন থাকতে না পারায়। আমার নিজেকে চোরের মত লাগছিল। আরেকজনের বাসা। তাদের অবর্তমানে... কিন্তু আর কোন পথ ছিল না। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম নানাভাবে।
মিনা গেটেই অপেক্ষা করছিল। আমাকে আর আরিফুলকে দেখে এগিয়ে এলো। হাসিমুখে ভিতরে নিয়ে গেল। আরিফুল টিভি অন করে ড্রইং রুমে সোফায় বসে গেল। বলল, ' মিনার সাথে যা, আমি একটু পর আসছি '। ডাইনিং রুম পার হয়ে মিনা আমাকে একেবারে কর্ণারের একটা রুমে নিয়ে গেল। মনে হল মিনার পড়ার রুম। ছোট। গুছানো। টেবিলের পাশে দেয়ালে শো কেসে অনেক বই। অন্যদিন হলে লোভ হত। সেদিন মন পড়ে আছে লাভলি'র কাছে। শো কেস থেকে জানালার দিকে ফিরতেই শরীরের সব রক্ত ছলকে উঠল। লাভলি! জানালার সামনে নিচু ডিভানটাতে বসা। হাতের ম্যাগাজিনের দিকে চোখ। ও চোখ তুলে তাকাল না। চা আনার কথা বলে মিনা হেসে দরজা থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার সময় পর্দাটা টেনে দিল। লাভলি তাকাল। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সেই তাকানো। আমার সমস্ত কিছুতে আমি সেই তাকানোটা অনুভব করছিলাম। কখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি নিজেও জানিনা। কতক্ষণ গেল তাও জানিনা। কী ভাবছিলাম তাও মনে নেই। ওর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করল। বুঝেই কিনা জানি না, ও আমার একটা হাত ধরল। আমার মাথার মধ্যে পাগলের মত সব ইচ্ছা ঝড় তুফান শুরু করল। হঠাৎ মনে হল এই ইচ্ছাগুলোর একটা ও যদি লাভলি বুঝতে পারে, ও আমাকে খারাপ ছেলে ভাববে। প্রচন্ড কষ্টে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। কিন্তু হাতটা ছাড়তে পারলাম না। নিয়তি আমাদের দু'জনকে অমোঘ টানে অন্তরাত্মায় এক করল। দুই হাত দুই হাতে ধরা অবস্থায় জীবনে প্রথম কোন মেয়ের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। আমার মুঠোর চাপে ওর হাতে ব্যথা পেয়ে মৃদু শব্দ করে উঠল। আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারছিলাম না। মন বলছিল ঠিক হচ্ছে না। আবার সেই মনই বলছিল এইই ঠিক! হঠাৎ ও আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। ফিরে দেখলাম পর্দার নিচে স্যান্ডেলপরা পা। মিনা শব্দ করল, 'আসবো? ' আমি পড়ার টেবিলের চেয়ারটাতে বসে গেলাম। হাসি পেয়ে গেল। ওদের ঘর, আমাদের কাছে অনুমতি চাচ্ছে! লাভলি বলল, 'আয়'। মিনা ট্রে হাতে ঢুকল। পিছন পিছন আরিফুল ও ঢুকল। রুমটা মুহুর্তে উচ্ছ্বল হাসিগল্পে মুখর হয়ে গেল। আমার ও খুব ভালো লাগছিল। কিছু না পাওয়ার বোধকে ছাড়িয়ে প্রাপ্তির সুখ রইল।
মিথিলা বাবু!
তোমার মায়ের সাথে এই বাড়িতে আর দু'একবার দেখা হয়েছিল আমার। মিনার মা আমাদের ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। আমাকে কিছু বলেননি। লাভলিকে একদিন বোঝালেন, 'এসব ভালো না। তোমাদের বয়স কম। এই বয়সে চিন্তা ভাবনা করে কেউ কিছু করে না। পরে তোমাদের মন বদলাতে পারে। এই বয়সের সম্পর্ক টিকে না। ছেলেরা বিয়ে ছাড়া সম্পর্কগুলি থেকে সুযোগ নেয়। কিছু বিপদ আপদ হয়ে গেলে সর্বনাশ হবে। ফেলে চলে গেলে কী করতে পারবে? আর, যদি আর কারো সাথে বিয়ে হয়, এসব তোমাকে কষ্ট দেবে.. '
লাভলি এসে সব আমাকে বলল। কথা শেষে জিজ্ঞেস করল, ' বিয়ে করবে আমাকে? ' আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ' বিশ্বাস করতে পারছো না আমাকে? ' ওকে কেমন অচেনা লাগল। বলল, ' বিয়ে করতে চাও?'
আমি ওর কথা বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের কারোরই বিয়ের বয়স হয়নি। আমি এখনো পড়ি। সংসার কিভাবে করবো? কোন উত্তর দিতে পারলাম না। লাভলি কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের আগে একদিন একজন সিনিয়র ভাই, থার্ড ইয়ারের রকিব ভাই আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেলেন।
চায়ের অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। হাসিমুখে নিজের ফার্স্ট ইয়ারের গল্প শোনালেন। আমাকে চা সমোসার দাম দিতে দিলেন না। বেশ ভালো লাগল।
রকিব ভাই চলে যাওয়ার পর সহপাঠী আব্দুল আলীম বলল,' উনি আমাদের কলেজে ছাত্রদলের মাথা '। এরপর অল্প সময়েই পরিচিত হলাম কলেজের ছাত্রলীগ, শিবির আর ছাত্র ফ্রন্টের কর্মী আর নেতাদের সাথে।
বি এল কলেজে ছাত্র শিবির এর আধিপত্য থাকলেও আমাদের সময়ে কেমন এক মিশ্র আধিপত্য বিরাজ করছিল। ছাত্রলীগ ও ছাত্র দল এক না হয়েও এক ছিল শিবিরের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। তারা ছিল কলেজের সর্বত্র। রাজনীতির গলি ঘুপচিতে আমার চলাফেরা শুরু হল।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৩৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উপস্হাপনার সাথে চলতে গিয়ে কত দূর চলে গেছি...... আত্মস্হ্ হতে সময় লাগল কিছু টা!
অনুভূতিতে ঘোরলাগা অনুভূত হল!
মন্তব্য আর কী করব..........!!!
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার হাত আরো প্রসারিত হোক এই কামনা করি।
শুভ সকাল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন